হীরের টুকরো
-জয়তী মিত্র
ও বৌমা অর্পণ ঘরে আছে?
-হ্যাঁ কাকিমা আছে, কিছু দরকার আছে?
-তোমার কাকুর কিছু ওষুধ আনতে দিতাম। আমার রাজ্যের কাজ পড়ে আছে তাই যদি অর্পণ ওষুধগুলো এনে দিত খুব ভালো হতো।
রুমি বললো, এনে দেবে কাকিমা চিন্তা করবেন না।
রায় গিন্নি বললেন, রুমি তোমাদের মত ভাড়াটে পেয়ে আমরা খুব খুশি, তোমরা কত দেখভাল করো আমাদের। তোমার জন্য আমার খুব খারাপ লাগে। কত বড়োলোকের মেয়ে তুমি, আর বিয়ে করলে শেষে একটা বেকার ছেলেকে তাও আবার অনাথ। শুনেছি কত বড়োলোকের ছেলের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আজ তুমি রাজরানী হয়ে থাকতে। সেটা না করে বেকার বর নিয়ে ঘর করছ। তাও তুমি শিক্ষিকার চাকরীটা করতে তাই দুজনের চলে যাচ্ছে, না হলে তো খুব খারাপ অবস্থা হতো তোমাদের।
রুমি রেগে গিয়ে বললো, বেকার তো ও নয়, চাকরী হয় তো করে না কিন্তু টিউশনি করে তো ভালই আয় করে, আর অনেক চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছে, একদিন ঠিক পাবে, আমি আগে পেয়েছি এই যা, আর আমরা দুজন দুজনকে ভালবেসে বিয়ে করে তো বেশ সুখে আছি তাই না কাকিমা, আর অর্পন ঘরে আছে বলেই না ওকে দিয়ে আপনার কাজটা করিয়ে নিতে পারছেন।
রায় গিন্নি কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।
রুমির সাথে অর্পণের দেখা এক বিয়েবাড়িতে। অর্পণের এক বন্ধুর দাদার বিয়েতে কন্যাযাত্রী হয়ে এসেছিল রুমি। সেখানেই পরিচয়। দুজনেই তখন কলেজে পড়ে। তারপর ফোন নম্বর আদান প্রদান থেকে বন্ধুত্ব, সেই বন্ধুত্ব পরিণতি পায় ভালোবাসায়। রুমি প্রথম ভালোবাসার প্রস্তাব দেয় অর্পণকে। অর্পণ রুমিকে ভালোবাসলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি।
ছোট বেলায় অর্পণের বাবা, মা মারা যায়, মামার বাড়িতে অনাথের মত মানুষ হয়। মাধ্যমিক পাশ করার পর মামা আর পড়াতে চায় নি অর্পণকে। কিন্তু নিজের চেষ্টায় পড়াশুনা চালিয়ে গেছে অর্পণ। বাচ্চাদের পড়িয়ে টাকা উপার্জন করে নিজের পড়ার খরচ চালিয়েছে, পড়াশুনায় ভালো ছিল বলে মাস্টার মহাশয়রাও তাকে সাহায্য করেছে। এইভাবেই কোনরকমে চলছিল অর্পণের জীবনযাত্রা। মামার বাড়িতে কোনোদিন ভালোবাসা পায়নি অর্পণ। মাঝে মাঝে মা-বাবার কথা ভেবে চোখের জল ফেলত।
রুমির ভালোবাসায় নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে অর্পণ। রুমি ছিল বড়লোক বাবার মেয়ে। তার একটা ভাইও ছিল। বাবার ছিল বিরাট কাপড়ের ব্যবসা। শহরের বুকে দু’টো বিরাট কাপড়ের শোরুম ছিল।
রুমির এই প্রেম তার বাবা, মা মেনে নেয় নি। স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু মেয়েকে কিছুতেই বিয়েতে রাজি করাতে পারেননি। রুমি ততদিনে সরকারী চাকরীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরী পেয়ে গেছে। অর্পণও চাকরীর চেষ্টা করছিল কিন্তু তখনও সে চাকরী পায় নি। অর্পণকে ডেকে একদিন রুমির বাবা, মা খুব অপমান করে, সহ্য করতে না পেরে সেইদিনই অর্পণের হাত ধরে রুমি ঘর ছাড়ে। তারপর কিছু বন্ধুর সাহায্য নিয়ে রেজিস্ট্রি বিয়ে করে রায় বাড়ীতে ভাড়া আসে। রুমির বাবা, মা আর খোঁজ নেন নি মেয়ের।
স্বামী, স্ত্রীর সুখেই দিন কাটছিল। একদিন টিউশনি পড়িয়ে ফেরার পথে এক জায়গায় জটলা দেখে এগিয়ে যায় অর্পণ। দেখে এক দুর্ঘটনায় এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক আক্রান্ত হয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সবাই দেখছে কিন্তু কেউ এগোচ্ছে না। চমকে উঠল অর্পণ। আরে এ যে রুমির বাবা। এমনিতেই কারো কিছু হলেই সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া অর্পণের স্বভাব। তৎক্ষণাৎ একজনের সাহায্য নিয়ে অর্পণ নিকটবর্তী হাসপাতালে রুমির বাবাকে ভর্তি করলো। খবর পেয়ে ছুটে এলো রুমির ভাই, মা আর রুমি। ডাক্তার বললেন, ঠিক সময়ে না আনলে ওনাকে বাঁচানো যেত না।
তারপর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে রুমির বাবা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। সেই সময় অর্পণের চাকরীর সুখবর আসে। রুমির খুব আনন্দ, তার স্বামী চাকরী পেয়েছে। এতদিনে অর্পণের মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন সফল হয়েছে। রুমিকে আর কেউ অর্পণের বেকারত্ব নিয়ে খোঁচা দেবার সাহস পাবে না। অর্পণকে জড়িয়ে ধরে রুমি বলে, আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী আমি।
অর্পণ বলে, তোমাকে পেয়ে আমার জীবন ধন্য, একটা অনাথ বেকার ছেলেকে তুমি ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছো। আর আমার চাওয়া, পাওয়ার কিছু নেই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যেন আমরা একে অপরের পরিপূরক হয়ে বাঁচতে পারি।
একদিন বিকালে রুমির মা, আর বাবা আসলেন মেয়ে জামাইকে নিজের বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। রুমির বাবা বিনয় বাবু বললেন, রুমি তুই ঠিক মানুষকে জীবন সঙ্গী বেছেছিস মা, আমি হীরে ফেলে কাঁচের পিছনে ছুটেছিলাম। যেখানে তোর বিয়ে ঠিক করেছিলাম সেই ছেলেটি ভালো নয়। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম। অর্পণ আমার হীরের টুকরো জামাই যার কাছে তুই সুখে আছিস। আমাকে ক্ষমা করে দিস মা, টাকাপয়সা দিয়ে সব সময় সব কিছুর বিচার হয় না, সেদিন আমি অর্পণকে অপমান করে খুব ভুল করেছি। আজ তার প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছি। অর্পণ না থাকলে আমি আজ এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতাম না। জামাইয়ের হাত ধরে বিনয় বাবু বলেন, আজ থেকে আর ভাড়া বাড়িতে নয়, আমার বাড়ীতে আমার বড়ো ছেলে হয়ে থাকবে।
অর্পণ বললো, আমি চাকরী পেয়ে গেছি এইবার আমরা একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট কিনে দুজনে থাকবো।
রুমির মা বললেন, সে পরে হবে… যতদিন ফ্ল্যাট না কেনা হচ্ছে ততদিন আমাদের কাছে থাকবে, চলো। তুমি আমাদের এইভাবে ফিরিয়ে দিও না।
মা’কে অর্পণের মনে পড়ে না। সেই কোন ছোটবেলাতে মা, বাবা তাকে ছেড়ে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। মায়ের কথা মনে পড়লেই বুকটা কষ্টে ভরে যেত অর্পণের। আজ আর এক মা তাকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে এসেছেন সেই ডাক উপেক্ষা করা সম্ভব হলো না অর্পণের। নতুন মা’কে পেয়ে নিজের মাকে হারানোর কষ্টটা আজ অনেকটা লাঘব হল অর্পণের।
বাড়িওয়ালী রায় গিন্নি রুমির মাকে বললেন অর্পণ সত্যি হীরের টুকরো ছেলে। ওর মতো ভদ্র, পরোপকারী ছেলে আজকের দিনে বিরল। অনেক ভাগ্য করে এমন জামাই পেয়েছেন।
চলে যাবার দিন অর্পণ রায় গিন্নিকে বলে, আসি কাকিমা, ভালো থাকবেন, প্রয়োজনে ফোন করবেন খুব তো বেশি দুর নয় আমি ঠিক চলে আসবো।
রায় গিন্নি বললেন, তোমার যখন খুশি এসো বাবা, আমিও তো তোমার মায়ের মতই। এই কয়েক মাসে তোমরা আমার নিজের সন্তানের মতই হয়ে গিয়েছিলে, যদি কখনও আমার কোনও কথাতে কষ্ট পেয়ে থাকো আমাকে ক্ষমা করে দিও।
অর্পণ বললো, কাকিমা ছেলের কাছে বুঝি কেউ ক্ষমা চায়? এমন কথা একদম বলবেন না। তারপর রুমিকে আদর করে রায় গিন্নি বলেন, আবার আসিস মা, কাকিমাকে ভুলে যাস না।
রুমি বললো, না কাকিমা তোমাকে কি করে ভুলে যাবো। এই কয়েক মাস তোমরাই তো আমাদের অভিভাবক ছিলে,আমাদের কত কিছু রান্না করে খাওয়াতে, একদম নিজের মায়ের মত। তোমার কথা আমার সব সময় মনে পড়বে। ভালো মন্দ রান্না করলে খবর দেবে এসে খেয়ে যাবো।
আর তোমাদের একটা খাওয়া পাওনা আছে, অর্পণ বললো। আমার চাকরীর পাওয়ার খাওয়াটা একদিন খাওয়াবো কাকিমা।
রায় গিন্নি বললেন, আমি খুব খুশি হয়েছি, যে তুমি একটা ভালো চাকরী পেয়েছো। তোমরা জীবনে সুখী হও এই কামনা করি।
তারপর রুমি আর অর্পণ কাকিমাকে প্রণাম করে বাপের বাড়ির পথে রওনা দেয়।